এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স কি?

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আশীর্বাদ হলো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার। অ্যান্টিবায়োটিকের অপর নাম হল অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ। এটি এমন একধরনের ওষুধ যা মানুষ এবং পশু উভয়ের শরীরেই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত ইনফেকশনের (বা রোগ সংক্রমণ) বিরুদ্ধে লড়াই করে। এক্ষেত্রে তারা হয় ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে, নয়তো ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার রোধ করে।

ব্যাকটেরিয়া হলো নিউক্লিয়াসবিহীন এককোষী, আণুবীক্ষণিক অণুজীব। এর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০। সব ব্যাকটেরিয়াই খারাপ নয় বরং অনেক ব্যাকটেরিয়াই, এমনকি আমাদের অন্ত্রে বাস করা যারা অত্যন্ত উপকারী। তবে ব্যাকটেরিয়ার ক্ষতিকর দিকই সচরাচর আমাদের নজরে বেশি পড়ে।

প্রতিবছরই বাড়ছে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা। সূত্র: PNAS

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট এর সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। সাধারণত ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাও ভিন্ন হয়। সঠিক পরিমাণে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করলে ব্যাক্টেরিয়াগুলো পরোপুরি ধ্বংস না হয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন এই ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোনো প্রভাব থাকেনা। এ অবস্থাকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলা হয়ে থাকে।
একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর বুক থেকে প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে পারে বলে ধারণা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো এমন একটি অবস্থা যা সংগঠিত হয় কতিপয় ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করার জন্য। এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এরা অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে অভিযোজিত হয়ে যায় বলে নিজেদের স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে মানুষ বা পশুর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।

আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে তাদের রোগ সেরে যেত, এখন আর সেই অ্যান্টিবায়োটিকে তা সারে না বরং ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে অত্যধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। অল্পতেই বা সামান্য মাথা ব্যাথা থেকে শুরু করে গুরুতর জ্বর অবধি প্রতিটি শরীর খারাপে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ব্যাতিক্রমী দু-এক ক্ষেত্রে রোগীর দেহে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া থেকে যাচ্ছে যা অ্যান্টিবায়োটিকের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা৷ বরং তারা অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল শিখে ফেলছে এবং তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও একই গুণাগুণ দেখা দিচ্ছে।

শিশুদের ক্ষেত্রেও কি এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স হয়?

আইসিডিডিআর,বি-র এক বিজ্ঞানী জানান, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের একটি বড় অংশের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা যায়। তিনি জানান, যারা হাসপাতালে ভর্তির তিন মাস আগেও কোনো এন্টিবায়োটিক খায়নি কিন্তু তাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়াগুলো মাল্টিপল ড্রাগ রেজিস্টেন্স। এর মানে শিশু এন্টিবায়োটিক না খেলেও প্রকৃতি-পরিবেশের কারণে তাদের শরীরে ওষুধ কাজ করছে না। অর্থাৎ আমরা কেউই এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স নই। শিশুরা তো নয়ই। বিশ্বে যে হারে নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরি করা হচ্ছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে সামান্য হাঁচি-কাশি-জ্বরেও মানুষের মৃত্যুঝুঁকি হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। একটি এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে লাগে ১৫ বছর তার বিপরীতে ব্যাকটেরিয়া রেজিস্টেন্স হতে লাগে এক বছর।

ছবি: এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হওয়ার অনেক গুলো প্রক্রিয়া হতে পারে। সূত্র: Action on Antibiotic Resistance

আগামী সাত বছরে দুইবারের বেশি এন্টিবায়োটিক আসার সম্ভাবনা নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এক সময় দেখা যাবে, রোগের জীবাণুকে কোনো ওষুধ দিয়েই ধ্বংস করা যাচ্ছে না। শিশুদের এমন এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স হওয়ার পেছনে জেনেটিক বা বংশগত কোনো কারণ নাও থাকতে পারে। তবে আমরা যেসব প্রাণীর মাংস বা শাকসবজি খাই সেইসব প্রাণীর শরীরে বা সবজির উৎপাদনে যদি এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে রেজিস্টেন্স তৈরি করে যার প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে। আমরা প্রোটিনের জন্যে মাছ, মুরগি, গরু ইত্যাদি খেয়ে থাকি এবং সেগুলোকে বাঁচানোর জন্যে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ মানুষকে তার প্রোটিনের জন্যে ভবিষ্যতকে ঝুঁকিগ্রস্ত করা হচ্ছে।

এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়

রোগাক্রান্ত মানুষ বা পশু অন্য কারো উপস্থিতিতে হাঁচি-কাশি প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের শরীরের আভ্যন্তরীণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয় এবং তারাও একই রকম দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়। ধারণা করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে, বছরে ১০ মিলিয়ন মানুষ পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে মারা যাবে এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগে মারা যাবে ৮.২ মিলিয়ন মানুষ। প্রাথমিক কিছু সচেতনতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা:

  • চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক কেনা/বিক্রি বর্তমানে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট এর মূল কারণ। এটি বন্ধ করতে হবে।
  • সব এন্টিবায়োটিক ওষুধের প্যাকেটের রং বদলাতে হবে এবং অন্যান্য ওষুধ থেকে আলাদা রাখতে হবে, যেন মানুষ সহজেই পার্থক্য করতে পারে।
  • এন্টিবায়োটিকের ডোজ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না, ডোজ সম্পূর্ণ করতে হবে এবং নিয়ম মেনে খেতে হবে।
  • সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়া এই চারটি রোগ সারাতে এন্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন নেই। তাই চিকিৎসককে এই চারটি কন্ডিশনে এন্টিবায়োটিক দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

Shart HealthCare

ব্লাড কালচারের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স সনাক্তকরণ

যখন কোন রোগ সনাক্ত করবার পরেও ঔষুধে ভালো হয় না, তখন আমরা ব্যাকটেরিয়াসমৃদ্ধ রক্তকে ল্যাবরেটরিতে পাঠাই। উদ্দেশ্য হল- কেন অতি সাধারণ একটা অসুখও ঔষুধ দিয়েও রোগ ভালো হচ্ছে না। ল্যাবে মাইক্রোবায়োলজিস্টরা সেই রক্তকে কয়েকদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সেখানকার ব্যাকটেরিয়াদের উপর বিভিন্ন প্রকার এন্টিবায়োটিক দিয়ে দেখেন, সেই এন্টিবায়টিক ব্যাকটেরিয়াগুলোক মেরে ফেলতে সক্ষম কী না!যদি মারতে পারে তখন সেই এন্টিবায়োটিকের পাশে লেখা হয়- S (S for Sensitive). সেন্সিটিভ শব্দের অর্থঃ ঐ এন্টিবায়োটিকটি ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে সক্ষম। যদি না পারে তখন লিখা হয়- R (R for Resistant). অর্থাৎ এখন আর এই এন্টিবায়োটিকটি ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে সক্ষম নয়। আগে কাজ করলেও ব্যাকটেরিয়া নিজেকে বদলে ফেলেছে। ফলে একই অস্ত্র (এন্টিবায়োটিক) দিয়ে ব্যাকটেরিয়াটিকে মেরে ফেলা যাচ্ছে না।

মানুষ ও পশুর দ্রুত রোগমুক্তি ও গড় আয়ু বৃদ্ধিতে অ্যান্টিবায়োটিকের অবদানের শেষ নেই। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে মানুষ ও পশুপাখি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে সঠিক চিকিৎসা না থাকায় মারা যেত। রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর ধ্বংস বা বংশবিস্তার রোধের ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ১৯২৮ সালে অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু এর যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে বর্তমানে জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিকে রেজিস্ট্যান্ট হচ্ছে। সংক্রমণকারী জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে। ফলে মুমূর্ষু মানুষ ও পশুপাখি চিকিৎসা জটিলতায় মারা যাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে মানুষ ও পশুপাখি অ্যান্টিবায়োটিক না থাকার কারণে মারা যেত, আর বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক থাকা সত্ত্বেও এর কার্যকারিতা জীবাণুর বিরুদ্ধে হ্রাস পাওয়ায় মুমূর্ষু মানুষ ও পশুপাখি বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ওষুধ সেবন করার বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে এই ভয়াবহ অভিশাপ ঠেকানো সম্ভব। এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে জানুন। ডাক্তার এর পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক কে না বলুন।

তথ্যসূত্র

About 10 Minutes Blog

10 Minutes Blog is online content publishing blogging website. What are you waiting for? You will get tons of resources, information, ideas, tools, free premium stuffs, and so on from 10 Minutes Blog.

View all posts by 10 Minutes Blog →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *