গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা – আরিফার টক খাবার খুব প্রিয়। সে যখন গর্ভবতী হয় তখন একদিন তেঁতুলের সাথে মিশিয়ে কাঁচা পেঁপে খেল বেশ ভালো পরিমানেই। খাওয়ার পর পরই তার পেটে ব্যথা শুরু হল এবং গর্ভপাত হয়ে গেল। হ্যাঁ এই রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায় অনেক সময়ই অজ্ঞতার কারণে। তাই গর্ভাবস্থায় একজন নারীর কী খাওয়া উচিৎ এবং কী খাবার বাদ দেয়া উচিৎ তা জানা থাকতে হয়।
সুস্থ থাকার জন্য সব সময়ই সুষম খাদ্য খাওয়া উচিৎ। কিন্তু গর্ভাবস্থার জন্য এটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভের শিশুটি যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে আপনাকেই। তাই পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে হবু মাকে। আবার এমন কিছু খাবার আছে যা গর্ভাবস্থায় খাওয়া নিরাপদ নয়। চলুন তাহলে জেনে নিই গর্ভাবস্থায় একজন নারীর কি ধরণের খাবার খাওয়া উচিৎ এবং কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিৎ এই বিষয়ে।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা – প্রেগন্যান্ট অবস্থায় যে খাবারগুলো খাওয়া উচিৎ :

১। ফল ও শাকসবজি
দিনে ৫ বার ফল ও ৭ বার সবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন। ফলের চেয়ে শাকসবজি বেশি খান। জুস ও স্মুদি ও পান করতে পারেন। তবে এগুলোর সুগার ব্লাড সুগার লেভেল বৃদ্ধি করতে পারে এবং দাঁতেরও ক্ষতি করতে পারে। তাই এগুলো সীমিত পরিমাণে পান করাই ভালো। তাজা ফল ও সবজি খাওয়াই বেশি স্বাস্থ্যকর।
২। স্টার্চ জাতীয় খাবার
আলু, লাল চালের ভাত, রুটি, পাস্তা ইত্যাদি স্টার্চ জাতীয় খাবার আপনার প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় রাখুন। শর্করা জাতীয় খাবার শরীরে এনার্জি প্রদানে সাহায্য করে।
৩। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
চর্বিহীন মাংস, মুরগী, মাছ, ডিম, ডাল (মটরশুঁটি, মসূর ডাল) ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান। সপ্তাহে ২ দিন বা তারচেয়েও বেশি মাছ খাওয়ার চেষ্টা করুন। সারডিন, স্যামন এর মত তৈলাক্ত মাছ বা সামুদ্রিক মাছ সপ্তাহে ১ দিন খেতে পারেন। আমিষ জাতীয় খাবার গর্ভের শিশুর শরীরের নতুন টিস্যু গঠনের জন্য সাহায্য করে।
৪। দুগ্ধজাত খাবার
দুধ, পনির, দই ইত্যাদি খাবারগুলো ক্যালসিয়ামের চমৎকার উৎস। এগুলোর চিনি ও ফ্যাটের পরিমাণ যেন কম থাকে সেটি খেয়াল করতে হবে। ফ্যাট জাতীয় খাবার শিশুর মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সাহায্য করে।
অনেক মানুষের শরীরেই আয়োডিনের ঘাটতি থাকে। আয়োডিন এমন একটি খনিজ উপাদান যা শিশুর মস্তিষ্কের গঠনের জন্য অপরিহার্য। দুগ্ধজাত খাবার ও সামুদ্রিক খাবার আয়োডিনের চমৎকার উৎস।
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর অনেক বেশি কাজ করে। তবে সাধারণত প্রথম ৬ মাসে বাড়তি ক্যালোরির প্রয়োজন হয়না। সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে যখনই ক্ষুধাবোধ হবে তখনই খাবেন।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ – প্রতিকার ও চিকিৎসা
Olive oil and Lemon Juice Benefits : The Surprising Benefits.
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা – প্রেগন্যান্ট অবস্থায় যে খাবারগুলো খাওয়া উচিৎ নয় :
১। কাঁচা ডিম
ডিম পুষ্টিকর একটি খাবার। অনেকেরই কাঁচা ডিম খাওয়ার অভ্যাস থাকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় কাঁচা ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ কাঁচা ডিমে সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাই ডিম ভালোভাবে সিদ্ধ না করে খাওয়া যাবেনা।
২। অর্ধসিদ্ধ মাংস
অর্ধসিদ্ধ মাংসে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। প্যাকেটজাত মাংস যেমন- সসেজ খাওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। মাংস ভালো ভাবে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে।
৩। অপাস্তুরিত দুধ
অপাস্তুরিত দুধ বা কাঁচা দুধে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাই ভালো করে না ফুটিয়ে দুধ পান করা যাবেনা। অপাস্তুরিত দুধ দিয়ে তৈরি খাবার যেমন- নরম পনির খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪। কলিজা ও কলিজার তৈরি খাবার
লিভারে রেটিনল থাকে যা একটি প্রাণীজ ভিটামিন এ। এর অতিরিক্ততা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৫। ক্যাফেইন
কফি ক্লান্তি দূর করার জন্য কার্যকর হলেও গর্ভাবস্থায় এর পরিমাণ কম করতে হবে। চা, কফি ইত্যাদিতে ক্যাফেইন থাকে। দৈনিক ২০০ গ্রামের বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ করা ঠিক নয়। অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম গ্রহণ করে। মিসক্যারেজের মত ঘটনাও ঘটতে পারে।
৬। সামুদ্রিক মাছ
সামুদ্রিক মাছ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু অধিক পরিমাণে খেলে গর্ভের শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। কারণ সামুদ্রিক মাছে পারদ জাতীয় পদার্থ থাকে।
৭। কাঁচা বা আধা পাকা পেঁপে
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কাঁচা বা আধা পাকা পেঁপে খাওয়া বিপদজনক। এতে গর্ভপাতের মত ঘটনা ঘটতে পারে।
Harvard School of Public Health প্রেগনেন্ট নারীদের জন্য হার্ভার্ড হেলথি ইটিং প্লেট নামে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। যেখানে তারা আস্ত শস্যদানার খাবার খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। স্বাস্থ্যকর ভেজিটেবল ওয়েল গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার সীমিত পরিমাণে অর্থাৎ দিনে ১/২ বার খাওয়ার জন্য বলা হয়। লাল মাংস সীমিত পরিমাণে এবং প্রসেসড মিট এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়াও রিফাইন্ড শস্য দিয়ে তৈরি সাদা পাউরুটি ও সাদা চালের ভাত এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার কথা বলা হয়েছে এবং চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা কেমন হওয়া উচিৎ তা জেনে নিই চলুন।
এখানে আমরা উদাহরণসরূপ কিছু আদর্শ খাবার রুটিনের কথা বলব। তবে আপনার বয়স, শারীরিক অবস্থা, ওজন ইত্যাদি বিবেচনা করে ভাল ডায়েট সাজেশন অবশ্যই আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নেবেন।
সকালে – সকালে অনেক গর্ভবতী নারীরই বমি বমি ভাব হয় এবং খেতে ইচ্ছে করেনা। সেক্ষেত্রে ভারী খাবার না খেয়ে হালকা চা (গ্রিনটি)ও বিস্কিট খেয়ে নিতে পারেন। এর বেশ খানিকটা পরেই ২ টি রুটি ও সবজি খেতে পারেন। সাথে একটি ডিম সিদ্ধ করে খাওয়া ভালো। বেলা ১০ টা/ ১১ টায় ১ গ্লাস ননী ছাড়া দুধ বা ফল বা ফলের জুস ও বাদাম খেতে পারেন।
দুপুরে – দুপুরে ১ বাটি ভাতের সাথে মাছ বা মাংস, সবজির তরকারী, শাক, ডাল এবং তাজা ফল ও সবজির সালাদ। খাওয়ার শেষে খেতে পারেন দই।
বিকালে – ভাঁজা-পোড়া খাবার না খেয়ে ঘরে তৈরি কোন স্বাস্থ্যকর স্ন্যাক্স বা কেক বা বাদাম বা মটরশুঁটি সিদ্ধ খেতে পারেন। ফল বা ১ গ্লাস ফলের জুস খেতে পারেন।
রাতে – রাতের খাবার দুপুরের মতোই হবে। তবে শাক রাতে না খাওয়াই ভালো। বেশি করে সবজির তরকারী খেতে পারেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ১ গ্লাস ননী মুক্ত দুধ পান করতে ভুলবেন না।
যাদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্ত চাপের মত সমস্যা আছে তারা ডাক্তারের দেয়া তালিকা অনুযায়ী খাবার খাবেন। ডায়েবেটিসের রোগীরা শর্করা ও মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে যেতে হবে এবং ব্লাড প্রেশারের রুগীদের লবণ খেতে হবে কম করে।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা – গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের খাবার তালিকা
বাচ্চার ডেভেলপমেন্টের জন্য গর্ভবতী মায়েরা প্রথম তিন মাস আপনার খাদ্য তালিকায় বিশেষভাবে খেয়াল রাখবেন যেন আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, ওমেগা-৩ যেন শরীরে এগুলোর অভাব তৈরি না হয়।
এছাড়াও গর্ভবতী মায়েরা সুষম খাদ্য বেশি বেশি খাবেন। আপনার শিশুটি যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় তা আপনাকেই নিশ্চিত করতে হবে। তবে এমন কিছু খাবার আছে যা গর্ভবতী মায়েদের খাওয়া নিরাপদ নয়। যেহেতু প্রেগনেসির প্রথম তিন মাস অনেক ঝুঁকিপূর্ণ তাই খাবারের দিকটা নিজেই খেয়াল রাখবেন।
এখন আসুন জেনে নেই গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় কেমন হবে, কি খাবার খাবেন এবং কি খাবার এড়িয়ে চলবেন সেই সম্পর্কে-
১। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
গর্ভবতী মায়েরা প্রথম তিন মাসে আপনাদের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার রাখবেন। ভিটামিন সি গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরী। ভিটামিন সি পাওয়া যায় যেসব খাবারে-
মালটা অথবা কমলা
মাল্টা বা কলমাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে। এই দুটি রঙিন ফল ভিটামিন সি’র ভালো একটি উৎস। চিকিৎসকগণ গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কমপক্ষে দুটি রঙিন ফল রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তার মধ্যে মালটা বা কমলাকে বেশি প্রেফার করে থাকেন।
প্রেগনেন্সির প্রথম সময়টা অনেক মায়েদের ভমিটিং বা বমি বমি ভাবটা বেশি থাকে। যার কারনে এই সকল মায়েরা মালটা কমলা ফলটি সহজে খেতে পারেন। মালটা ফলটি সারা বছরই পাওয়া যায়। যার কারণে এটি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
কাঁচা মরিচ
কাঁচা মরিচ থেকেও আপনি ভিটামিন সি নিতে পারেন। প্রতিদিনের খাবারের সাথে একটি করে কাঁচা মরিচ খেতে পারেন। তবে প্রেগনেন্সির সময় খাবার খেতে অনেকের সমস্যা হয়ে থাকে, তাই আপনি নিজেই ঠিক করে নিবেন কোন খাবারটা খেলে আপনার জন্য ভালো হয়।
আমড়া ও পেয়ারা
যেকোনো টকজাতীয় ফল থেকে আপনি ভিটামিন সি নিতে পারেবেন। আমড়া ও পেয়ারা থেকেও পর্যাপ্ত ভিটামিন সি পাওয়া যায়। আমড়া সিজনাল ফল হলেও পেয়ারা কমবেশি সারা বছরই পাওয়া যায়।
তবে প্রেগনেন্সির সময় সিজনাল যে ফলই পাবেন সেটি বেশি করে খেতে পারেন। সিজনাল সব ফল থেকে আপনি পরিপূর্ণ পুষ্টি নিতে পারবেন।
এছাড়াও ফুলকপি ও ক্যাপসিকাম থেকে ভিটামিন-সি পাবেন। বিভিন্ন কালারের সবজি মিক্স করে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে যাতে ভিটামিন-সি টা বাদ না পড়ে।
২। ফলিক এসিড
গর্ভবতী মা এবং শিশুর উভয়ের জন্য ফলে অ্যাসিড বা ভিটামিন বি৯ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর জন্মগত ত্রুটি এড়াতে এর ভূমিকা অনেক।
তাই গর্ভধারণের তিনমাস আগে থেকে দৈনিক ৪০০ মাইক্রো গ্রাম ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা জরুরি। তবে এটি প্রাকৃতিক খাবার থেকে গ্রহণ করা বেশি ভালো। যে সকল খাবারে ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়
মালটা
মালটাতে ভিটামিন সি এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলিক এসিড পাওয়া যায়। এই ফলটি প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। এটি সুস্বাদু ও সহজলভ্য একটি ফল। গর্ভবতী মায়েরা চাইলে এটি জুস তৈরি করেও খেতে পারেন।
১০০ গ্রামের একটি মাল্টাতে ৫৫ মাইক্রো গ্রাম ফলিক এসিড রয়েছে। যা একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য ১৪ শতাংশ পর্যন্ত ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণ করে।
এছাড়াও এতে প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
পাকা কলা
কলা একটি সহজলভ্য ফল এবং এটি সারা বছরই পাওয়া যায়। কলায় রয়েছে পটাসিয়াম, ভিটামিন বি৬। পাকা কলাতে প্রায় সকল প্রকার ভিটামিন ও মিনারেল থাকে। অন্যান্য ফলের থেকে পাকা কলাতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফলিক এসিড। যা গর্ভবতী মায়েদের দৈনিক চাহিদার অনেকাংশ পূরণ করে থাকে।
১০০ গ্রাম পাকা কলাতে ২৩.৬ মাইক্রো গ্রাম ফলিক এসিড রয়েছে। এছাড়াও দুধ, মধু, সবুজ শাক-সবজি ও রঙিন, ডাল ও বিভিন্ন বীজে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলিক এসিড পাবেন।
৩। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
গর্ভবতী মায়েদের জন্য আয়রন অনেক বেশি প্রয়োজন। এই সময়টা আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখবেন, দৈনিক খাবারের তালিকা থেকে যাতে কোনভাবে আয়রন বাদ না পড়ে।
আয়রন আপনার গর্ভের শিশুর বিকাশে সাহায্য করবে এবং প্রসবকালে আপনার রক্তপাতের পরিমাণ কম পড়বে। আয়রনের ঘাটতি থাকলে শরীরে যথেষ্ট অক্সিজেন পাবেনা।
অনেক খাবার থেকে আয়রন পেতে পারে যেমন খেজুর, কিসমিস, কচুশাক, সামুদ্রিক মাছ, পালং শাক, ডাল, ডার্ক চকলেট, বাদাম, আপেল ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত আয়রন পাবেন।
প্রতিদিনের খাবারের সাথে দুই থেকে তিনটি খেজুর ও কিছু কিসমিস খেতে পারেন। এটি আপনার আয়রনের চাহিদা পূরণ করবে। এটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়ামও রয়েছে।
এছাড়াও কচু শাক, ডাল, ডার্ক চকলেট, মুরগী, মাছ, ডিম এগুলোও আপনার দৈনিক খাবারের রাখতে পারেন। সারাদিনে অথবা রাতে একটি করে আপেল খেলে আপনার আয়রনের চাহিদা পূরণ হবে।
৪। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের খাবার তালিকায় ভিটামিন এ এর চাহিদা পূরণের জন্য রঙিন শাকসবজি ও ফল বেশি খেতে বলা হয়। বিভিন্ন রকমের রঙিন সবজি যদি একসাথে মিক্স করে খাওয়া যায় তাহলে এটি থেকে ভিটামিন এ এর চাহিদা পূরণ হয়। এর পাশাপাশি রঙিন ফল খেতে হবে। এছাড়াও কলিজাতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ভিটামিন এ থাকে।
তবে প্রেগনেন্সির সময় কলিজাতে প্রচুর ভিটামিন এ থাকার কারণে এটি খেতে নিষেধ করা হয়। কারণ ভিটামিন এর পরিমাণ বেশি হলেও প্রেগনেন্সিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৫। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রথম তিন মাসে মায়েরা দৈনিক খাবারে দেশি মাছ, মাংস, ডিম, মুরগি, ডাল এই খাবারগুলো খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখবেন।
যারা মাছ মাংস কম খেতে পারেন তারা চেষ্টা করবেন কমপক্ষে একটি ডিম খেতে। যদি সম্ভব হয় দৈনিক ২ টি করে ডিম খাবেন। যারা এ সময় ডিম সিদ্ধ খেতে পারেন না, তারা এদিকে ফর্টিফাইড করে খেতে পারেন। যেমন ডিমের সাথে আলু মিক্স করে, ভর্তা করে খেতে পারেন বা ডিমটাকে ভেজে খেতে পারেন। অথবা ডিমের হালুয়া তৈরি করেও খেতে পারবেন।
এই সময়ে বেশি বেশি ছোট মাছ খাবেন। ছোট মাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। কম খাবারে বেশি ক্যালরি পেতে আলু, ডিম, ডাল অল্প করে মিক্স করে খাবেন।
মাছ অথবা মাংসের সাথে দুই তিন কালারের সবজি অল্প করে মিক্স করে খেতে পারেন। এই মিক্স খাবারটাকে বলা হয় হোক ফর্টিফিকেশন।
৬। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
দুধ, দই, পনির ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে। ফ্যাট জাতীয় খাবার শিশুর দাঁত হাড় ও মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সাহায্য করে।
গর্ভবতী মায়েরা প্রতিদিন এক গ্লাস করে দুধ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন। যদি দুধ খেতে সমস্যা হয় তাহলে দই বা দুধের তৈরি অন্য খাবার খেতে পারেন। তবে অবশ্যই খাদ্য তালিকায় ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার রাখবেন। ক্যালসিয়াম ছাড়াও দুগ্ধজাত খাবারে পর্যাপ্ত আয়রন থাকে, যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
অন্য সময়ের তুলনায় গর্ভ অবস্থায় একজন মায়ের বেশি ক্যালোরি ও পুষ্টির দরকার হয়। এজন্য গর্ভবতী মায়েদের খাবার গ্রহণের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, যখনই ক্ষুধাবোধ হবে তখনই খাওয়া এবং কম কম করে বারবার খাবেন।
৭। স্টার্চ জাতীয় খাবার
আলু, লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত, পাস্তা ইত্যাদি এই খাবারগুলো স্টার্চ সমৃদ্ধ। গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য তালিকায় কার্বোহাইড্রেট জাতীয় এই খাবার গুলো রাখতে হবে।
আপনি চাইলে লাল আটার রুটি, পাস্তা, আলু এগুলো সকালের নাস্তায় রাখতে পারেন। লাল চালের ভাতের সাথে বেশি পরিমাণ সবজি নিয়ে খেলে মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে।
গর্ভকালীন এই সময়ে নিজের টেস্ট অনুযায়ী নিজেই খাদ্য চার্ট তৈরি করে নিবেন। নিজের খাবারগুলো সাধ্য অনুযায়ী নিজে তৈরি করে খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
৮। তরল খাদ্য গ্রহণ
তরল খাবারের মধ্যে গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরী। বেশি পানি পান করতে সমস্যা হলে সাথে ডাবের পানি ও সেলাইন যোগ করে খেতে পারেন।
এছাড়াও ভেজিটেবল সুপ, চিকেন সুপ এই জাতীয় তরল খাবার গুলো খাবেন। একজন গর্ভবতী মায়ের দৈনিক ১৮ থেকে ২০ গ্লাস পানি খেতে বলা হয়। এটি শিশুর বৃদ্ধি এবং তার হরমোনকে ব্যালেন্স করার জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন হয়।
৯। ভিটামিন ডি গ্রহণ
গর্ভাবস্থায় সন্তানের জন্য ভিটামিন-ডি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন-ডি শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সাহায্য করে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশের জন্য গর্ভবতী মায়ের গর্ভ অবস্থা প্রথম থেকেই ভিটামিন ডি গ্রহণ করা জরুরি।
ভিটামিন ডি এর প্রধান সূর্যের আলো। আমরা সূর্যের আলো থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ভিটামিন ডি পায়। পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি পেতে গর্ভাবস্থায় মায়েরা কমপক্ষে ৩০ মিনিট সরাসরি যতটুকু সম্ভব হয় স্ক্রিনে সূর্যের আলো লাগাবেন। এটি বুদ্ধির বিকাশের পাশাপাশি শিশুর হাড় গঠনে সাহায্য করবে।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা – গর্ভকালীন ডায়েট চার্ট: কী খাবেন কী খাবেন না
বর্তমানে অতিরিক্ত কম ওজন বা বাড়তি ওজনের কারণে গর্ভবতী মায়েদের বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর এ জন্য দরকার একটি যথাযথ গর্ভকালীন ডায়েট চার্ট । গর্ভধারণের সময়কে মূলত তিনটি ত্রৈমাসিকে ভাগ করা হয়েছে যেখানে ০ থেকে ১৩ সপ্তাহকে বলা হয় ১ম ত্রৈমাসিক, ১৪ থেকে ২৬ সপ্তাহ সময়কে বলা হয় ২য় ত্রৈমাসিক এবং সবশেষে ২৭ থেকে ৪০ সপ্তাহ সময়কে বলা হয় শেষ অর্থাৎ ৩য় ত্রৈমাসিক। প্রথম ত্রৈমাসিকে খাবারের পরিমাণে ক্যালরির পরিমাণ পরিবর্তন না হলেও পরবর্তী দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে প্রতিদিন অন্তত অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালরি ও ৪৫০ ক্যালরির করে বাড়তি খাবার গ্রহণ করতে হবে।
খাবারের তালিকা:
ঘুম থেকে উঠে
সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানির সঙ্গে রাতে ভিজিয়ে রাখা চার থেকে পাঁচটি কাঠবাদাম খেতে হবে। বাদামে রয়েছে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট, ফলিক অ্যাসিড,ভিটামিন ডি ও জিংক যা ভ্রূণের মস্তিষ্ক, শিশুর হৃদযন্ত্র এবং স্নায়ুবিক বিকাশে সাহায্য করে।
সকালের খাবার
সকালের নাস্তায় পরিমাণমতো ভাত, রুটি বা ওটসের সাথে অবশ্যই আমিষ জাতীয় খাবার যেমন মসুরের ডাল, মাছ বা মাংস রাখতে হবে। মসুরের ডালে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফোলেট যা বাচ্চার মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ায় এবং জন্মকালীন ঝুঁকি কমায়।
মিড মর্নিং নাস্তা
একসাথে বেশি খাবার না খেয়ে গর্ভকালীন ডায়েট চার্ট মেনে চলতে হলে অল্প অল্প করে খেতে হবে। মিড মর্নিং নাস্তা হিসেবে গর্ভবতী মায়েদের জন্য সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সিদ্ধ ডিম ও খেজুর। ডিমের কুসুমে রয়েছে কোলিন যা গর্ভের সন্তানের মেধা বাড়ায় ও পাশাপাশি এতে বিদ্যমান প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন ডি, বি১২, বি২ এবং প্রয়োজনীয় মিনারেল থাকে যা ভ্রূণের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক বিকাশে সাহায্য করে। এটি শিশুকে স্পাইনা বিফিডা এবং অ্যানেনসেফালির মতো রোগে আক্রান্ত হতে বাধা দেয়। পাশাপাশি খেজুরে রয়েছে প্রচুর আয়রন যা গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতা রোধে সাহায্য করে।
দুপুরের খাবার
একজন গর্ভবতী মাকে দুপুরের খাবারে ভাতের পাশাপাশি খেতে হবে সামুদ্রিক মাছ বা লাল মাংস ও প্রচুর শাকসবজি। সামুদ্রিক মাছে রয়েছে আয়েডিন এবং প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড যেমন ওমেগা ৩ ও ৬ যা বাচ্চার ব্রেইনের উন্নতি সাধন করে। লাল মাংস অর্থাৎ গরুর মাংস ও দেশি মুরগির মাংসে রয়েছে প্রচুর আয়রন যা রক্তস্বল্পতার রোধে পাশাপাশি বাচ্চার সুষম গঠনে উন্নতি সাধন করে। তবে এ আয়রন শোষণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পাশাপাশি উচ্চ ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন আমলকি,কমলা বা লেবু খেতে হবে।
বিকালের স্বাস্থ্যকর নাস্তা
গর্ভকালীন ডায়েট চার্ট মেনে চলার সময় ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখা চাই। তাই তৈলাক্ত নাস্তার পরিবর্তে খেতে হবে ক্যালরিবহুল স্বাস্থ্যকর নাস্তা। এসময় খাবারের তালিকায় রাখা যায় চিকেন সুপ, দুধ ও বাদাম/পপকর্ন, মিক্স ফল বা ছোলা-মুড়ি, সালাদের যেকোনো একটি। দুধ গর্ভবতী মায়েদের জন্য একটি উত্তম খাবার কারণ দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন এ, ডি ও ই পাশাপাশি কিছু প্রয়োজনীয় অন্যান্য মিনারেল যা শিশুর দাঁত, হাড়,নখ ও চুলের গঠনেও সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম শোষণেও ভিটামিন-ডি লাগে যা পাশাপাশি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
রাতের খাবার
রাতে শর্করাযুক্ত খাবারের পরিমাণ সামান্য কমিয়ে আমিষ জাতীয় খাবার যেমন মসুরের ডাল, ডিম, সামুদ্রিক মাছ বা মাংস বেশি খেতে হবে। পাশাপাশি সবজি বা সালাদ রাখতে হবে রাতের খাবারে। তবে গর্ভবতী মায়েদের এসিডিটির সমস্যা প্রতিরোধে রাতে ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাবার সেরে ফেলতে হবে।
গর্ভকালীন যেসব খাওয়া যাবে না
১। অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালরিবহুল শর্করাযুক্ত খাবার যেমন মিষ্টি খাবার, ফাস্টফুড, পানীয়, তেলের পিঠা খাওয়া যাবে না। কারণ এগুলো গর্ভবতী মায়েদের ওজন ও রক্তচাপ বাড়ানোর পাশাপাশি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
২। চা-কফি অর্থাৎ ক্যাফেইন যুক্ত খাবার আয়রন শোষণে বাধা দেয় যার ফলে মা এবং শিশুর উভয়ের পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা জনিত সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়।
৩। কামরাঙ্গা, আনারস বা কাঁচা পেঁপেতে কিছু এনজাইম থাকে যা ১ম ত্রৈমাসিকে ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে।
৪। অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। কারণ এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি পায়ে পানি আসা বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ফুলে যেতে পারে।